এক সন্ধ্যার গল্প

আজ সেলিম মামা আসবেন। নার্সকে ছুটি দিয়ে দিয়েছি। শেষ রোগীটাও একটু আগেই চলে গেছে। চেম্বারে আমি একা।
গুলশান দু নম্বর গোল চত্বরে পঁচিশ তলা ভবনের একেবারে উপরের তলায় আমার চেম্বার। বেশ নিরিবিলি। জানালা দিয়ে ঢাকা শহরের মনোরম বার্ডস আই ভিউ দেখা যায়।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। আকাশে এখন আবছা অন্ধকার। গাড়ির লাল নীল বাতি রাস্তায় আলোর জলসা বসিয়েছে। আমার বান্ধবী মৌমিতা মাঝে মাঝে এসে এখান থেকে রাতের রাস্তার লং-এক্সপোজার ছবি তোলে। ওগুলো আবার ফেইসবুকে অনেক লাইক পায়।
সেলিম মামা সকালবেলা মা'কে ফোন করে বলেছেন, অফিসের কাজ কাল ঢাকায় এসেছেন। ক'দিন থাকবেন। কিন্তু গত রাত থেকে ওনার বাঁ দিকের আক্কেল দাঁতে প্রচন্ড ব্যথা আরম্ভ হয়েছে । সারারাত ঘুমুতে পারেননি।
মামার সাথে আমার অনেকদিন যোগাযোগ নেই, আসলে ঢাকায় মামা খুব কমই আসেন। মা'র সঙ্গে মাঝে মধ্যে মামার ফোনে আলাপ হয়। মা'র নিজের কোন ভাই নেই, এই খালাতো ভাই-ই নাকি তার আপন ভাইয়ের মত। মা মামাকে বলেছেন,
'রুনু তো এখন নামকরা ডেন্টিস্ট, তুই ওকেই দেখা’ ।
সেলিম মামা এলেন সন্ধ্যার দিকে। আমি তো মামাকে দেখে প্রথমে চিনতেই পারিনি। এক সময়ের ডাকসাইটে জওয়ান মর্দ মামা দাড়িটাড়ি রেখে কী একটা অবস্থা। বাঙ্গালী অনেক পুরুষ মধ্যবয়স পর্যন্ত ইচ্ছেমত মউজমাস্তি করে শেষ বয়সে হঠাৎ একশ’ আশি ডিগ্রী টার্ন নেয়। যদি থাকে পরকাল, ঝুঁকি নিয়ে কী লাভ? মামা মনে হয় সেরকম। ওনার সুরমা মাখা চোখে এখন নুরানি জেল্লা। মামা আমার পিঠে হাত রেখে বললেন,
'রুনু, তুই এত বড় হয়ে গেছিস, চেনাই যাচ্ছে না তোকে'
আমি মামার নুরানি চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
'কত বছর পর দেখলেন বলেন তো?’
মামা বললেন,
'পনের বছর তো হবেই, আসলে এক শহরে থাকলেই এখন যাওয়া আসা হয়না, আর আমি তো থাকি খুলনা’ ।
মামা খুলনার একটা কলেজের শিক্ষক। মা বলেছেন মামার রিটায়ারমেন্টের আরও বছর পাঁচেক বাকি । আমরা খুলনা ছেড়েছি বিশ বছর হলো। আমার এস এস সি পরীক্ষার পর পর। আমাকে ঢাকায় ভালো কলেজে পড়াবার জন্য বাবা অনেক কষ্টে বদলী ম্যানেজ করে ঢাকা চলে এসেছিলেন। সেটা ফল দিয়েছিল, আমি ঢাকা ডেন্টাল কলেজে পড়েছি। অনেক বছর একজন নামকরা ডাক্তারের অধীনে কাজ করেছি। এখন আমার নিজের চেম্বার আছে , নাম ধামও হয়েছে কিছুটা। মা বিয়ের জন্য চাপ দেন, কিন্তু আমার কোন ইচ্ছে করে না।
মামার দিকে তাকিয়ে চিকিৎসার সরঞ্জাম প্রস্তুত করতে করতে বললাম,
'মামী নাকি ভীষণ অসুস্থ?’
মামা করুণ মুখ করে বললেন,
'আর বলিস না, ব্রেস্ট ক্যান্সারের শেষ স্টেজ, ডাক্তার বলেছে হাসপাতালে রেখে লাভ নেই, তাই বাসায় নিয়ে এসেছি'।
'মা বললো ,আপনি নাকি আরেকটা কলেজের মেয়েকে…’।
মামা আমার কথা শেষ করতে না দিয়ে বললেন ,
'তোর মামীকে দেখার জন্য কাউকে লাগবে তো, আরেকটা বিয়ে করেই ফেললাম'
উনি মামীর সম্মতি নিয়েছেন কি না আর জানতে চাইলাম না। মামী নিশ্চয় জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে এই পৃথিবীর সাথে সম্পর্ক এমনিতেই ঘুচিয়ে ফেলেছেন। মামাকে ডেন্টাল চেয়ার দেখিয়ে বললাম,
‘মামা শুয়ে পড়ুন। মা বললো আপনার বা দিকের উপরের দাঁতে প্রচন্ড ব্যথা, তাই তো? ’
মামা চশমা খুলে একদিকে রাখতে রাখতে বললেন,
‘হ্যাঁ রে রুনু ,কাল চারটা প্যারাসিটামল খেয়েও কিছু হয়নি, অফিসের কাজে এসে দেখ কী ঝামেলায় পড়লাম। সালমা মানে তোর নতুন মামী ফোনে বললো লবণ পানি দিয়ে গারগেল করতে, তাও করলাম, কোলাভ হলো না’
'আমাকে একটা এক্সরে করতে হবে মামা, তার আগে কিছুই বলতে পারছি না'
আমি এক্সরে গান মামার গালের উপরে রেখে, মুখের ভেতরে ছোট একটা এক্সরে ফিল্ম বসিয়ে বললাম,
'মামা, একটু কষ্ট করে ফিল্মটা চেপে ধরে রাখুন, নড়বেন না, এক মিনিট লাগবে’
তারপর চেম্বারের দেয়ালে একটা সুইচে চাপ দিয়ে ফিরে এলাম। এক্সরেতে দেখা যাচ্ছে সেকেন্ড মোলার দাঁতে গভীর ক্ষত হয়ে গেছে। ইনফেকশন মূলের দিকে চলে যাচ্ছে, রুট ক্যানেল ছাড়া বোধহয় গতি নাই। মামাকে বলতেই মামা ভয় পেয়ে গেলেন। আমি মামাকে অভয় দিয়ে বললাম, ‘চিন্তা করবেন না মামা, আগের দিনের মত রুট ক্যানেলে দশ বারোটা সেশন লাগে না। এখন দু তিন বসায় হয়ে যায়। আপনার যে অবস্থা, আগে ক'দিন অ্যান্টিবায়টিক নিতে হবে। তবে আজ বাইরের দিকটা ড্রিল করে টেম্পরারি ফিলিং দিয়ে দেখি ওতে কাজ হয় কিনা’।
মামা এখন সটান হয়ে শুয়ে পড়েছেন। আমি চেয়ারের উপরের সারজিকাল লাইটটা অন করলাম। মামার চোখ এখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে আলোর দিকে চলে গেছে।
আমি মামাকে হাঁ করতে বললাম। মামা সুবোধ বালকের মত হাঁ করলেন। আমি এবার ড্রিল মেশিন চালু করলাম। ঝি ঝি ঝি ঝি শব্দ হচ্ছে ড্রিল মেশিন থেকে। ড্রিল মেশিনটা নষ্ট দাঁতে ছুঁতেই মামা ছ্যাঁত করে উঠে বললেন,
‘ দাঁতে তো চিন চিনে ব্যাথা লাগছে, অবশ করার ইনজেকশন দিবি না’
‘’জি মামা, বশ অবশ সব হবে, একটু হাত পা টানটান করেন’
'আচ্ছা যা ভালো বুঝিস কর, তুই এক্সপার্ট’
মামা হাত পা টানটান করলেন। আমি মামার হাত আর পেটের উপর দিয়ে একটা আর পায়ে উপর দিয়ে আরেকটা বেল্ট টেনে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে দিয়ে বললাম,
‘এখন আর চাইলেই উল্টোপাল্টা নড়াচড়া করা যাবে না মামা, আমার জন্য ওতেই সুবিধা’
মামাকে শুইয়ে রেখে আমি ওয়ার্কটপের কাছে গেলাম, ওখান একটা ক্রিস্টালের ফুলদানিতে এক গোছা রজনী গন্ধা । রজনী গন্ধার একটা ডাঁটা এনে মামার হাতে দিয়ে বললাম,
‘ফুলটা ডান হাতে ধরে রাখেন মামা, পরে দরকার হবে’
মামা ডান হাতে রজনীগন্ধা ধরে টান টান শুয়ে রইলেন । আমি আবার ড্রিল মেশিনটা চালু করে মামার নষ্ট দাঁতে চেপে ধরলাম। মামা ব্যথায় কাতরাচ্ছেন । গোঁগোঁ করে বোধহয় আবার বললেন,
’অ্যানাস্থেসিয়া দিবি না । ব্যথা লাগছে অনেক’,
আমি বললাম,
‘মামা ধৈর্য ধরেন। অ্যানাস্থেসিয়া দিচ্ছি একটু পর, লোকালে হবে না আপনার, জেনারেল লাগবে ’
মামা ব্যথা নিয়েও আশ্বস্ত হলেন।
'আমি এবার পাশের টুল বক্স থেকে ডেন্টাল সাঁড়াশিটা বের করলাম। মামার বোধহয় এবার ভয় লাগছে। মুখ বন্ধ করে রেখেছেন।
এমন হয়, পেশেন্টরা মাঝপথে ভয় পেয়ে বসে। এদের জন্য অন্য দাওয়াই আছে। আমি একটা ডেন্টাল ওপেনার এনে মামার দুই ঠোঁটের মাঝে বসিয়ে দিয়ে বললাম,
‘মামা ,এখন আর ভয়ে মুখ বন্ধ হয়ে যাবে না’
মামা গোঁ গোঁ গো করে উঠলেন। এবার মামার মুখের দিকে সাঁড়াশি নিতে নিতে বললাম,
‘মামা, লায়লা আমাকে সব বলেছিল’
মামা চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকালেন। আমি বললাম,
‘লায়লাকে মনে নাই মামা? আমার স্কুলের বান্ধবী। আমার মামা মানে অনেকটা ওরও মামা। মনে আছে আপনাদের বাগানে রজনীগন্ধা ফুলের চাষ হতো। লায়লাকে রজনীগন্ধা ফুল দিবেন বলে বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন। মামী বোধহয় তখন ওনার বাপের বাড়িতে ’
কথা বলতে বলতে আমি মামার সামনের একটা দাঁত সাঁড়াশি দিয়ে ক্যাড়ম্যাড় করে তুলে আনলাম। সামনের দাঁতগুলোর শেকড় মাড়ির খুব গভীরে যায় না, তুলতে সময় লাগেনি। তবে রক্ত বেরোচ্ছে। আমি মামার মাড়িতে একটু তুলা চেপে ধরে বললাম,
‘আপনি লায়লাকে ঘরে নিয়ে জোর করে ওর জামা কাপড় খুললেন, তারপর মুখ চেপে ধরে অতটুকু মেয়েকে রেপ করলেন। ওর এক হাতে তখনো আপনার দেয়া রজনীগন্ধা। খুব ভয় দেখিয়েছিলেন ওকে, তাইনা? কাঊকে বলেনি অনেকদিন। তা ছাড়া আপনি অনেকটা নিজের মামার মতো, কে বিশ্বাস করবে ওর কথা? ’
এবার চোয়ালের নীচে ফার্স্ট মোলারে সাঁড়াশি ধরতেই মামা আপ্রাণ চেষ্টা করলেন হাত পা নাড়াতে, কিন্তু সব তো বেল্ট দিয়ে বাঁধা। আমি ওই শক্ত দাঁত সাঁড়াশি দিয়ে মোচড়াতে মোচড়াত বল্লাম,
'লায়লা আত্মহত্যা করেছে জানেন তো? ধর্ষণের দুঃস্বপ্ন ও আসলে কোনদিন ভুলতে পারেনি। শি ওয়াজ অ্যা ডিস্টারবড সোল’
মোলার দাঁতগুলোর দুটো শেকড় মাড়ির অনেক গভীর যায়। আমি সমস্ত শক্তি দিয়ে সাঁড়াশি টানতে টানতে বললাম,
‘লায়লা বিষ খেয়েছিল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মরেনি, হাসপাতালে মরেছে। মরার আগে আমাক সব বলে গেছে। তা না হলে ভাবতাম শুধু আমিই বুঝি আপনার ভিক্টিম’।
মামা আক্কেল দাঁতটা খুলে এসেছে। গলগল করে মাড়ি দিয়ে রক্ত বেরচ্ছে। ওখানে তুলা গুঁজতে গুঁজতে বললাম,
‘আপনি কী ভেবেছলেন? আট ন' বছর বয়সের কথা একদম ভুলে যাব? আপনি দিনের পর দিন আমার প্যান্টে হাত ঢুকিয়ে দিতেন, পরে বুঝলাম অন্য ছোট মেয়েদের সাথেও একই কাজ করতেন, কেউ কিছু বলার সাহস পায়নি। মনে হতো বললে আপনি আমদেরকে মেরেই ফেলবেন’
আমি সাঁড়াশিটা আবার আগাতেই মামা গোঁ গোঁ করে উঠলেন। দাঁতের ব্যথায় নাকি আমার কথা শুনে কে জানে।
একটা একটা করে মামার ছয়টা দাঁত তুলে ফেললাম। মনে হচ্ছে শুধু মাড়ি আছে, কোন দাঁত নাই। এখন জেনারেল অ্যানাস্থেসিয়া দিতে হবে। এরকম অবস্থায় মুখের অক্সিজেন মাস্ক চেপে ধরাও মুশকিল। কিন্তু কী করার। বললাম,
‘মামা আপনাকে এখন অজ্ঞান করে দেব, তারপর আপনার ওই অঙ্গটি কেটে ফেলব। না না আপনি কিছুই টের পাবেন না। সেলাইটেলাই করে দেব । কাল সকালের ভেতর মোটামুটি ট্যাক্সিতে উঠে হোটেলে ফিরে যেতে পারবেন। আমার কথা আবার কাউকে বলেবন না। পুরোনো সব পাপ কিন্তু উঠে আসবে, বুঝেছেন তো?’
আমি মামার মুখে মিশ্র গ্যাসের মাস্ক চেপে ধরে বললাম,
'মামা, এবার মনে মনে গুণুন, এক, দুই, তিন...’ ।
মামা ধীরে ধীরে জ্ঞান হারাচ্ছেন। মামার হাতের মুঠো থেকে রজনীগন্ধা ফুলটা খসে পড়েছে।
এশরার লতিফ, কথাসাহিত্যিক এবং সিনিয়র লেকচারার (অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর), ওয়েলস স্কুল অফ কার্ডিফ ইউনিভার্সিটি।