মুক্তিযুদ্ধ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

৭ই মার্চ ১৯৭১। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আগুনঝরা কণ্ঠে রেসকোর্স ময়দান থেকে শোষিত মানুষের মুক্তির ধ্বনি ভেসে আসে "এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম"। সে ডাকে সাড়া দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনে ঝাঁপিয়ে পড়েন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ স্বাধীনতায় রয়েছে দেশের সব শ্রেণির মানুষের অসামান্য অবদান। স্বাধীনতার জন্য পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে পিছ পা হয়নি এদেশের মানুষ। ত্রিশলক্ষ সূর্যসন্তান তাদের জীবনের বিনিময়ে আর দু'লক্ষ মা,বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করে আমাদের জন্য রেখে গেছেন ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই মানচিত্র আর লাল-সবুজের পতাকা।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশের আপামর জনতা, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-শিক্ষক ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে। স্বাধীনতা যুদ্ধে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি দেশের শিক্ষিত সমাজের রয়েছে অসামান্য অবদান। সেই অবদানের এক বিশাল অংশজুড়ে রয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মচারী-কর্মকর্তারা।
স্বাধীনতা যুদ্ধ সহ দেশের জাতীয়তাবাদ রক্ষার যে কোন আন্দোলনে রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অসামান্য অবদান। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে ৭০-এর সাধারণ নির্বাচন, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
এই ক্যাম্পাসে ঘুমিয়ে আছেন সারা বাংলার লাখো ছাত্রের পথচলার অনুপ্রেরণা, ছাত্রদের অধিকার আদায়ে নিজ জীবনকে উৎসর্গ করা, দেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. শামসুজ্জোহা স্যার। ড.শামসুজ্জোহা স্যার তৎকালীন সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও রয়াসন বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি গণ-আন্দোলনের চলাকালে উনসত্তরের ১৮ ফেব্রুয়ারি শহিদ হন। ড.শামসুজ্জোহা স্যার ছাত্র-ছাত্রীদের অকৃত্রিম স্নেহ ভালোবাসার চরম মূল্য দিয়েছিলেন জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে। তাঁর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর গণআন্দোলন অতি দ্রুত গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। তাঁর নির্মম মৃত্যু প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের মসনদ নড়বড়ে করে দেয়, মাস খানেকের মধ্যে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
মো.এনামুল হকের "রাজশাহীতে মুক্তিযুদ্ধ" গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর জনসাধারণের প্রবল প্রতিরোধে অল্প কয়েক দিনের মধ্যে রাজশাহীতে দূর্বল হয়ে পরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। অবশেষে স্থানীয় ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় পাক বাহিনী কিন্তু, ১০ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি বিপুল অংশ রাজশাহী শহরে প্রবেশ করে। ১৩ এপ্রিল ভোরে পাক সেনারা গুলিবর্ষণ করতে করতে প্রবেশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে। জোহা হল, জিন্নাহ (বর্তমান শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক) হলসহ অন্যান্য আবাসিক হল, বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব ও অতিথি ভবন দখল করে নেয়। ধ্বংসযজ্ঞ চালায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার, গ্রন্থাগার, ল্যাবরেটরি সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের, শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালার স্বাধীনতা সংগ্রাম,১৯৭১ এর ব্লকের তালিকা থেকে জানা যায়, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে প্রতিহত করার সময় শাহাদতবরণ করেন ৩ জন শিক্ষক, ৮ জন ছাত্র সহ ১৫ জন কর্মকতা-কর্মচারী।বিশ্ববিদ্যালয় দখলের পরদিন অথ্যাৎ ১৪ এপ্রিল সংস্কৃত বিভাগের শহীদ অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দার স্যারকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করে হত্যা করে লাশ গুম করা হয়, অতঃপর স্যারের কোন সন্ধ্যান পাওয়া যায় নি। এরপর দিন অথ্যাৎ ১৫ এপ্রিল গণিত বিভাগের অধ্যাপক হবিবুর রহমানকে সেনাবাহিনী তুলে নিয়ে যায়। অধ্যাপক মীর আবদুল কাইয়ুম স্যার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি বাঙালি স্বাধিকার আন্দোলনের একজন একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। সেই কারণে তিনিও পাকবাহিনীর কোপানলে পড়েন। ২৫শে নভেম্বর তাঁকে তাঁর শশুরবাড়ি (ঘোড়ামারা) হতে সেনাবাহিনীর ক্যাম্পেন ডাকছে বলে ডেকে নিয়ে যায়। অতঃপর স্যারের আর খোঁজ পাওয়া যায় নি। দেশ হানাদার মুক্ত হবার পর ৩১ ডিসেম্বর বোয়ালিয়া ক্লাবে নিকট বাবলাবোনা বালুচর হতে কতকগুলো গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। তার মধ্যে স্যারের লাশ ছিলো বলে ধারণা করা হয়। অধ্যাপক হাবিবুর রহমান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের রিডার ছিলেন। ১৫ এপ্রিল বিগ্রেডিয়ার আসলাম ও কর্নেল তাজের নির্দেশে সেনাবাহিনী তাঁকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। তারপর স্যারের ও কোন সন্ধ্যান পাওয়া যায় নি।
এছাড়াও শহীদ হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী, এমাজউদ্দীন সেখ, সাইফুল ইসলাম, মোঃ কলিম উদ্দিন, আবুল আলী, শফিকুর রহমান, মোঃ চারু মিয়া, মোঃ ইউসুফ, আবদুল মজিদ, আঃ রাজ্জাক, আবদুল মালেন, আবদুল ওয়াহাব, কোরবান আলী, মোঃ আফজাল, মোহন লাল, ওয়াজেদ আলী।
মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ভূমিকাও ছিল অসামান্য। স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়ে শহীদ হয়েছেন বাণিজ্য বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবদুল মান্নান, শাহজাহান আলী, আমিরুল হুদা, গোলাম সারওয়ার সাধন, মোহাম্মদ আলী খান, মিজানুল হক গেয়ারা, রেজাউল করিম, ফজলুল হক।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দখলে নিয়ে সাধারণ মানুষের ওপর নির্মম নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালায় পাক বাহিনী। নির্যাতনের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হত শহীদ শামসুজ্জোহা হল। বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হলের পাশে খোঁজ পাওয়া যায় গণকবরের। যেখানে ভয়াবহ নির্যাতনের প্রমাণ মিলে। গণকবর খনন করে পাওয়া গিয়েছিলো সহস্র মানুষের মাথার খুলি, হাড়, কঙ্কাল। এছাড়াও মিলেছে মানুষের ব্যবহৃত হাতঘড়ি ও কলম, টুপি, এক ও দশ টাকার নোট, চাবির রিং, সাইকেলের চাবি, কানের দুল, সিগারেটের লাইটার, মানিব্যাগ, কাজলের টিউব, ওড়না, পাথর বসানো আংটি, চিরুনি সহ বিভিন্ন ব্যবহারের জিনিস। পরবর্তীকালে এগুলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালায় সংরক্ষণ করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে বিভিন্ন স্মৃতি-স্মারক, হল, ভাস্কর্য, ম্যূরাল, বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা। বিজয় অর্জনে শহীদদের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ এ জাতি কখনো ভুলবে না। ভুলবে না রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান। আগামী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তুলতে অনুপ্রেরণার বাতিঘর হিসেবে এখন কাজ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
লেখক: আরিফুল ইসলাম
শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়