বাংলা থিয়েটারের স্বর্ণযুগ ও 'বঙ্গের গ্যারিক' গিরিশচন্দ্র ঘোষ

গিরিশচন্দ্র ঘোষ বিশিষ্ট বাঙালি সংগীতস্রষ্টা, কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যপরিচালক ও নট। বাংলা থিয়েটারের স্বর্ণযুগ মূলত তারই অবদান।
১৮৭২ সালে তিনিই প্রথম বাংলা পেশাদার নাট্য কোম্পানি ন্যাশানাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন। গিরিশচন্দ্র প্রায় চল্লিশটি নাটক রচনা করেছেন এবং ততোধিক সংখ্যক নাটক পরিচালনা করেছেন। জীবনের পরবর্তী ভাগে তিনি রামকৃষ্ণ পরমহংসের এক বিশিষ্ট শিষ্য হয়েছিলেন।
নানা রঙের আধার, গিরিশচন্দ্র ঘোষ প্রথমে অভিনেতা, তার পরে মঞ্চাধ্যক্ষ এবং তার পরে নাট্যকার। একই সঙ্গে কবিবর, সাঙ্গীতিক, প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক। কিন্তু তাঁর নাট্যকার পরিচিতির জনপ্রিয়তায় বহু সত্তা ঢাকা পড়ে গেছে। অভিনয়-শিল্পী গিরিশচন্দ্রের মহত্তম চরিত্রগুলি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই অভিনয়শৈলী ভুলতে পারেননি। ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকে শোকোন্মাদ ভীমসিংহের চরিত্র যেখানে ’ গিরিশের ‘মানসিংহ’ গর্জনে কয়েক জন দর্শক বিহ্বল পড়ে গেয়েছিলেন। ‘জনা’ নাটকে তিনি বিদূষকের ভূমিকায় অসামান্য অভিনয় প্রদর্শন করে সিরিয়ো-কমিক শৈলীর সাথে বঙ্গমঞ্চের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। বিশিষ্ট দর্শক ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন জগাই-মাধাই চরিত্রে গিরিশ-মুস্তাফীর অনন্যসাধারণ অভিনয়ের কথা। ঠিক যেন নটের শরীরের দুই অংশ দু’টি আলাদা ভঙ্গিতে কথা বলছে। আর এক বিশিষ্ট দর্শক গিরিশচন্দ্র কে চাক্ষুষ ধর্ষণ করে তাঁর স্মৃতিকথা শুনিয়েছেন আরএক তরুণ অভিনয়-শিক্ষার্থীকে। ‘শিবাজী’ নাটকে ‘আওরংজেব’-এর চরিত্রে গিরিশচন্দ্র গোটা মঞ্চে আলোড়ন তুলে দিয়েছিল। তাঁর চাউনি, সংযম, স্বরপ্রয়োগ— সবই তাঁর অসামান্য অভিনয় দক্ষতার ই ফল। তিনি স্টেজের সঙ্গে অন্য জগতের যোগ স্থাপন করে ফেলতেন তাঁর বলিষ্ঠ অভিনয় ক্ষমতার মাধ্যমে ।
১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দের ২৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতার বাগবাজারে গিরিশচন্দ্রের জন্ম। তিনি ছিলেন তাঁর পিতামাতার অষ্টম সন্তান। বাল্যকালে পিতা নীলকমল ঘোষকে হারিয়ে তিনি বন্ধুবান্ধবদের মাঝে বিশৃঙ্খল জীবনযাপনে মত্ত হয়ে ওঠেন। গিরিশচন্দ্র প্রথমে পাইকপাড়া স্কুল, হেয়ার স্কুল ও পরে ওরিয়েন্টাল সেমিনারি বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন।কিন্তু ১৮৮২ সালে তিনি এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অসফল হন। পবর্তীকালে ইংরেজি ও হিন্দু পুরাণে জ্ঞান অর্জন করেন। কিছুকাল পরে হাফ-আখরাই গানের দলের সাথে যুক্ত হয়ে গিরিশচন্দ্র অভিনয় ও সঙ্গীতের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন। ধীরে ধীরে অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা জাগে। এই ভালোবাসা থেকেই বাগবাজার অঞ্চলের বন্ধুদের সাথে নিয়ে তিনি একটি থিয়েটারের দল প্রতিষ্ঠা করেন।
১৮৬৭ সালে শর্মিষ্ঠা নাটকের গীতিকার হিসাবে নাট্যজগৎতে প্রথম যুক্ত। দু'বছর পরে সধবার একাদশিতে অভিনয় করে বেশ সুনাম অর্জন করে ছিলেন। কলকাতায় ন্যাশানাল থিয়েটার নামে তার একটি নাট্য কোম্পানি ছিল। ১৮৮৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর নটী বিনোদিনীকে নিয়ে তিনি স্টার থিয়েটার, কলকাতা চৈতন্যলীলা নাটকটি মঞ্চস্থ করেন। বিনোদিনীর ইচ্ছা ছিল যে নতুন থিয়েটার তৈরি হবে তা বিনোদিনীর নামে বি-থিয়েটার হবে । কিন্তু কিছু মানুষের প্রতারনার শিকার তিনি হন । যাঁদের মধ্যে তার নিজের অভিনয় গুরু গিরিশচন্দ্র ঘোষ ছিলেন । রামকৃষ্ণ পরমহংস এই নাটক দেখতে এসেছিলেন। এরপর উভয়েই তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
কাজী নজরুল ইসলাম গিরিশচন্দ্রের ভক্ত ধ্রুব উপন্যাসটি চলচ্চিত্রায়িত করেন। ১৯৫৬ সালে মধু বসুর পরিচালনায় গিরিশচন্দ্রের অবলম্বনে নির্মিত মহাকবি গিরিশচন্দ্র চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়।
গিরিশচন্দ্র প্রায় ১০০ টি নাটক রচনা করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাটক প্রায় ৭৫ টি। প্রকৃতিগত দিক থেকে তাঁর নাটকগুলিকে কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। সেগুলি নিম্ন রূপ―
১.পৌরাণিক নাটক
রাবণবধ (১৮৮১)
সীতার বনবাস (১৮৮২)
সীতার বিদ্রোহ (১৮৮২)
লক্ষ্ণণ বর্জন (১৮৮২)
রামের বনবাস (১৮৮২)
সীতাহরণ (১৮৮২)
পান্ডবের অজ্ঞাতবাস (১৮৮৩)
পাণ্ডব গৌরব (১৮৮৩)
চৈতন্য লীলা (১৮৮৬)
নিমাই সন্ন্যাস (১৮৯২)
জনা (১৮৯৪)।
২.চরিত্র নাটক
রূপ সনাতন (১৮৮২)
চৈতন্যলীলা (১৮৮৬)
নিমাই সন্ন্যাস (১৮৯২)
বুদ্ধদেব চরিত (১৮৯২)
বিল্বমঙ্গল ঠাকুর
শঙ্করাচার্য (১৯১০)
৩.রোমান্টিক নাটক
মুকুলমুঞ্জরা
আবু হোসেন
৪.সামাজিক নাটক
প্রফুল্ল(১৮৮৯)
হারানিধি (১৮৯০)
মায়াবসান (১৮৯৮)
বলিদান (১৯০৫)
৫.ঐতিহাসিক নাটক
সিরাজদ্দৌলা (১৯০৬)
মীরকাশিম (১৯০৬)
ছত্রপতি শিবাজী (১৯০৭)
অশোক (১৯১১)
৬.কৌতুক নাটক
হীরার ফুল (১৮৮৪)
সপ্তমীতে বিসর্জন (১৮৮৫)
বড়দিনের বখশিশ (১৮৯৩)
৭.গীতিনাট্য
অকালবোধন (১৮৭৭)
আগমনী (১৮৭৭)
মোহিনীপ্রতিমা (১৮৮২)
স্বপ্নের ফুল (১৮৯৩)
অশ্রুধারা (১৯০১)
৮.গল্প, উপন্যাস ও কাব্যের নাট্যরূপ
কপালকুণ্ডলা (১৮৭৩)
বিষবৃক্ষ (১৮৭৪)
দুর্গেশনন্দিনী (১৮৭৮)
মেঘনাদবধ (১৮৭৭)
হিমালয়ে জীবন্ত মানুষ (১৮৭৭)
পলাশীর যুদ্ধ (১৮৭৮)
চোখের বালি (১৯০৭)
১৮৭৭ সালে মেঘনাদবধ কাব্যে রামচন্দ্র ও মেঘনাদ উভয় ক্ষেত্রে অভিনয় জন্য সাধারণী পত্রিকার সম্পাদক অক্ষয়চন্দ্র সরকার তাকে 'বঙ্গের গ্যারিক' আখ্যায় ভূষিত করেন।
১৯১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি এই মহান অভিনেতা